বর্ষাকাল এলেই ডেঙ্গু জ্বরের আতঙ্কে সবাই থরথর করে কাঁপে! এই প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাংলাদেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই এই মশাবাহিত রোগের কারণ এবং লক্ষণ সম্পর্কে অবগত নন।
এডিস মশার কামড় খেলে সাধারণত ৩ দিন বা তার বেশি সময়ের মধ্যে উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, ত্বকে ফুসকুড়ি, গাঁট এবং পেশিতে ব্যথার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। এরপর রোগীর অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায়।
তবে ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার অনেক উপায় আছে। প্রথমত, রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এজন্য তাকে এমন খাবার দিতে হবে যাতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি এবং ভিটামিন থাকে, যা তাকে দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করবে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা ডেঙ্গু রোগীর একটি পুরনাঙ্গ খাবার তালিকা কী খাবেন আর কী এড়িয়ে চলবেন তা সরবারহ করবো। সথেই থাকুন…
ডেঙ্গু রোগীর খাবার তালিকাঃ কি কি খেতে হবে?
ডেঙ্গু চিকিত্সার সময়, আপনার খাদ্যতালিকায় নিম্নলিখিত খাবারগুলি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত:
-
- চর্বিহীন লাল মাংস, যেমন হাঁস এবং গরুর মাংস
- সাদা মাংস, যেমন মুরগি, টার্কি এবং মাছ
- ডিম
- দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য , যেমন দুধ, দই, মাখন এবং পনির
- ফল যেমন তরমুজ, কমলা, লেবু, আম, আপেল, কাঁঠাল, পেঁপে, আনারস, তরমুজ ইত্যাদি
- শাকসবজি , যেমন পালং শাক, কচুশাক, লালশাক, মুলাশাক, ডাঁটাশাক, বেগুন, ওলকপি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি ইত্যাদি
এই খাবারগুলি প্রোটিন এবং আয়রন সমৃদ্ধ, যা রক্তাল্পতা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করতে সক্ষম। ডেঙ্গু রোগীর রক্তক্ষরণের ফলে প্লেটলেট এবং হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে, যে কারণে এই খাবারগুলি খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে ডেঙ্গু রোগীর কিছু খাবার তালিকার বিবরণ দেওয়া হলঃ
পেঁপে পাতা
অনেক গবেষকই তার গবেষনায় দেখেছেন যে পেঁপে পাতা এই বিপজ্জনক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ডেঙ্গু রোগীর প্লেটলেট সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে, যা বিপজ্জনকভাব কমে যায়। সাধারণত, ডাক্তার গন এই পাতাগুলি জুস আকারে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে।
খাওয়ার উপাইঃ
- মাঝারি আকারের ১/২টি পেঁপে নিন এবং ছোট ছোট টুকরো করে কাটুন।
- এবার কাটা টুকরাগুলো একটি পাত্রে নিন।
- এখন এতে ১/২ কাপ কমলালেবুর রস এবং ২ থেকে 3 চামচ তাজা লেবুর রস যোগ কর।
- এরপর ১ চামচ মধু এবং স্বাদমতো কিছুটা কালো গোলমরিচের গুঁড়া এবং লবণ ছিটিয়ে দিন।
- সামগ্রীগুলিকে একটি ব্লেন্ডারে নিন, সামান্য জল যোগ করুন এবং মসৃণ জুসে মিশিয়ে নিন।
- তাজা অবস্থায় পান করুন।
ভেষজ মিশ্রণ
অনেক স্বাস্থ্যকর্মী ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে নিয়মিত তুলসী, অ্যাশ্বাগন্ধা, আদা, গিলয় (একটি আয়ুর্বেদীয় ভেষজ মিশ্রণ) এবং অ্যালোভেরা খাওয়ার পরামর্শ দেন। এছাড়াও অনেক ডাক্তার আমলকির ইনটেক বাড়ানোর পরামর্শ দেন, কারণ এটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ।
কমলালেবু
ডেঙ্গু রোগীদের কমলালেবু খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে। কমলালেবুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি শরীরকে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। কমলালেবুতে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে, যা ডেঙ্গু রোগীদের ডিহাইড্রেশন রোধ করতে সাহায্য করে। এটি শরীরকে তরল ধারণ করতে সাহায্য করে এবং জ্বর এবং মাথাব্যথার মতো ডেঙ্গুর লক্ষণগুলি উপশম করতে সাহায্য করে।
কমলালেবুতে থাকা ভিটামিন সি শরীরের ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করে। ডেঙ্গু রোগীদের প্রায়ই রক্তপাতের সমস্যা হয়, এবং ভিটামিন সি এই সমস্যাটি কমাতে সাহায্য করতে পারে। কমলালেবুতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি শরীরকে ক্ষতিকারক ফ্রি র্যাডিকেলগুলি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। এই ফ্রি র্যাডিকেলগুলি ডেঙ্গু রোগের কারণে যে ক্ষতি হয় তা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
দারুচিনি
ডেঙ্গু রোগীদের দারুচিনি খাওয়ার বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে। দারুচিনিতে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টি-ভাইরাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ডেঙ্গুর লক্ষণগুলি উপশম করতে সাহায্য করে।
দারুচিনিতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদানগুলি ডেঙ্গু রোগের কারণে সৃষ্ট প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। প্রদাহ জ্বর, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা এবং অন্যান্য লক্ষণগুলির কমাতে দারুচিনি সাহায্য করে।
দারুচিনিতে থাকা অ্যান্টি-ভাইরাল উপাদানগুলি ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং এটি ভাইরাসের সংখ্যা কমাতে এবং রোগের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে।
মেথি
ডেঙ্গু রোগীর মেথি খাওয়ার বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে। মেথিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা শরীরকে ক্ষতিকর উপাদান থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও, মেথিতে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান, যা ডেঙ্গুর কারণে সৃষ্ট ব্যথা এবং জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে। মেথিতে রয়েছে ফাইবার, যা হজমশক্তি বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা, কারণ ডেঙ্গুর কারণে অনেক রোগীই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভোগেন।
আদা
ডেঙ্গু সাধারণত ডিহাইড্রেশন ঘটায়। তাই ইলেক্ট্রোলাইট এবং গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির সাথে ভরপুর নারকেল পানি পান করা অত্যন্ত উপকারী। অনেক ক্ষেত্রে, আদা জলও সুপারিশ করা হয়, কারণ এতে ডেঙ্গু রোগীরা ভাল অনুভব করেন এবং বমি বমিভাব মোকাবেলা করতে সাহায্য করে।
ডাব
ডেঙ্গু রোগে রোগীর শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বেরিয়ে যায়। ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণে ইলেকট্রোলাইট থাকে যা পানিশূন্যতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। ডাবের পানিতে ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ডাবের পানিতে পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে যা রোগীর দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য সহায়ক।
ডেঙ্গু রোগীর কোন খাবারগুলি এড়ানো উচিত
ডেঙ্গু রোগীর জন্য কিছু খাবার এড়ানো উচিত, কারণ এগুলি রোগের লক্ষণগুলি আরও খারাপ করতে পারে বা দ্রুত আরোগ্য লাভের পথে বাধা দিতে পারে।
এড়ানো উচিত এমন খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে:
- ফাস্ট ফুড: ফাস্ট ফুড প্রক্রিয়াজাত এবং উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত, যা ডেঙ্গু রোগীর জন্য হজমে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
- ভাজাপোড়া খাবার: ভাজাপোড়া খাবার প্রক্রিয়াজাত এবং উচ্চ চর্বিযুক্ত, যা ডেঙ্গু রোগীর জন্য হজমে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
- কাঁচা সবজি বা কাঁচা খাবার: কাঁচা সবজি বা কাঁচা খাবারগুলিতে অন্ত্রের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকতে পারে, যা ডেঙ্গু রোগীর জন্য আরও খারাপ হতে পারে।
- অতিরিক্ত শক্ত খাবার: অতিরিক্ত শক্ত খাবার হজমে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
- কড়া দুধ-চা, কফি, এনার্জি ড্রিংক: কড়া দুধ-চা, কফি, এনার্জি ড্রিংকগুলি হজমে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে এবং দ্রুত আরোগ্য লাভের পথে বাধা দিতে পারে।
- অ্যালকোহল: অ্যালকোহল রক্তের জমাট বাঁধার ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে, যা ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়।
ডেঙ্গু রোগীর জন্য খাদ্য গ্রহণের সময় কিছু বিষয় মনে রাখা উচিত:
- ছোট ছোট অংশে খাবার খাওয়া উচিত।
- খাবার ভালভাবে চিবিয়ে খাওয়া উচিত।
- খাবার খাওয়ার পর বিশ্রাম নেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু রোগীরা যদি কোনও নির্দিষ্ট খাবার খাওয়ার পর কোনও অসুবিধা অনুভব করেন তবে সেই খাবারটি এড়ানো উচিত।
ডেঙ্গু রোগীর ৩ দিনের ডায়েট প্ল্যান
ডেঙ্গু রোগীর জন্য একটি আদর্শ ডায়েট প্ল্যান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু রোগীর শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে তরল বেরিয়ে যায়, তাই এটি প্রতিস্থাপন করাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ডায়েটে প্রচুর পরিমাণে ফল, শাকসবজি এবং ভাত বা আলু থাকা উচিত। এটাতে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন এবং ক্যালোরির একটি ভাল উত্স থাকা উচিত।
এখানে একটি 3 দিনের ডায়েট প্ল্যান রয়েছে যা ডেঙ্গু রোগীদের জন্য উপযুক্ত:
দিন 1
- নাস্তা: ফলের সালাদ (আপেল, কমলা, আঙুর)
- দুপুরের খাবার: ভাত, ডাল, সবজি
- রাতের খাবার: আলু, মাছ, সবজি
দিন 2
- নাস্তা: দুধ, ওটমিল
- দুপুরের খাবার: রুটি, দই, ফল
- রাতের খাবার: নুডলস, মুরগি, সবজি
দিন 3
- নাস্তা: ইয়োগারট, ফল
- দুপুরের খাবার: চাল, ডাল, শাক
- রাতের খাবার: পরোটা, ডিম, সবজি
এই ডায়েট প্ল্যানটি কেবলমাত্র একটি নির্দেশিকা। আপনার ডাক্তার বা পুষ্টিবিদের সাথে আপনার নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তাগুলি নিয়ে আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে আরও কিছু নির্দিষ্ট খাবার রয়েছে যা ডেঙ্গু রোগীদের জন্য উপকারী:
- ফল: আপেল, কমলা, আঙুর, আম, কলা, তরমুজ, শসা
- শাকসবজি: সবুজ শাক, টমেটো, গাজর, আলু, মটরশুটি
- প্রোটিন: মাছ, মুরগি, ডিম, দুধ, ডাল
- কার্বোহাইড্রেট: ভাত, আলু, রুটি